তারবিহীন যোগাযোগ ব্যবস্থায় তথ্য আদান-প্রদানের জন্য যে মাধ্যম ব্যবহৃত হয় তাকেই তারবিহীন মাধ্যম বলে। তারবিহীন যোগাযোগ ব্যবস্থায় তড়িৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের সাহায্যে দূরবর্তী স্থানে তথ্যের আদান-প্রদান করা হয়। এই ক্ষেত্রে অ্যান্টেনা (Antenna) ডেটা আদান-প্রদানে একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এই তড়িৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ এক ধরণের আলোক রশ্মি। তড়িৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের কম্পাঙ্ক বা তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের সম্পূর্ণ রেঞ্জকে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক স্পেকট্রাম (তড়িৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গগুচ্ছ) বলা হয়। এই স্পেকট্রামের ক্ষুদ্র অংশ আমরা খালি চোখে দেখতে পাই, যা আলো নামে পরিচিত। সম্পূর্ন স্পেকট্রামকে বৈশিষ্ট্য অনুসারে কতোগুলো ছোট ছোট রেঞ্জে বিভক্ত করে বিভিন্ন নামকরণ করা হয়েছে। যথাঃ বেতার তরঙ্গ, মাইক্রোওয়েভ, ইনফ্রারেড, আলোক রশ্মি, অতিবেগুনী রশ্মি, এক্স-রে ও গামা রশ্মি।

তারবিহীন যোগাযোগ ব্যবস্থায় নিচের তিন ধরণের তরঙ্গ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যথাঃ
১। বেতার তরঙ্গ (Radio Wave)
২। মাইক্রোওয়েভ (Microwave)
৩। লোহিত আলোক রশ্মি (Infrared)
উপরের তরঙ্গের সাহায্যে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ও পয়েন্ট-টু-মাল্টিপয়েন্ট যোগাযোগ করা যায়। এই ক্ষেত্রে দুই ধরণের অ্যান্টেনা ব্যবহৃত হয়।
১। ট্রান্সমিটার অ্যান্টেনা
২। রিসিভার অ্যান্টেনা
ট্রান্সমিটার অ্যান্টেনা তড়িৎ সিগন্যালকে তড়িৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গে রূপান্তর করে যা বায়ু, পানি ও মহাশূন্য দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছতে পারে। রিসিভার অ্যান্টেনা তড়িৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গকে তড়িৎ সিগন্যালে রূপান্তর করে।
সিগন্যাল কীভাবে প্রেরণ বা গ্রহণ করে তার উপর ভিত্তি করে অ্যান্টেনা দুই ধরণের। যথাঃ
১। দিকযুক্ত অ্যান্টেনা (Directional Antena)
২। দিকবিহীন অ্যান্টেনা (Omni Directional Antena)
দিকযুক্ত অ্যান্টেনা (Directional Antena)
এই ধরণের ট্রান্সমিটার অ্যান্টেনা তরঙ্গকে টর্চলাইটের আলোর মত একদিকে প্রেরণ করে এবং রিসিভার অ্যান্টেনা ঐ তরঙ্গ গ্রহণের জন্য মুখোমুখি(Line of Sight) অবস্থানে থাকতে হয়।
দিকবিহীন অ্যান্টেনা (Omni Directional Antena)
এই ধরণের ট্রান্সমিটার অ্যান্টেনা তরঙ্গকে বাল্বের আলোর মত চারদিকে প্রেরণ করে এবং রিসিভার অ্যান্টেনা ঐ তরঙ্গ সবদিক থেকেই গ্রহণ করতে পারে।
রেডিও ওয়েভ
3KHz হতে 300KHz ফ্রিকোয়েন্সির ইলেকট্রোম্যাগনেটিক স্পেকট্রামকে বলা হয় রেডিও ওয়েভ। এই তরঙ্গের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য 1mm থেকে 100km পর্যন্ত হয়ে থাকে। এই রেঞ্জের ফ্রিকোয়েন্সি সাধারণত বেতার যোগাযোগে ব্যবহৃত হয় বলে একে রেডিও ওয়েভ বলা হয়। এক্ষেত্রে প্রতিটি কম্পিউটার একই ফ্রিকুয়েন্সিতে সেট করা থাকে যাতে এগুলো অন্য কম্পিউটার থেকে সিগনাল গ্রহন করতে পারে।
রেডিও ওয়েভ দুই ধরণের। একটি হচ্ছে নিয়ন্ত্রিত, অন্যটি হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত। নিয়ন্ত্রিত রেডিও ওয়েভ সরকারের অনুমতি ছাড়া কেউ ব্যবহার করতে পারে না।
রেডিও ওয়েভ তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত।
লো-পাওয়ার সিঙ্গেল ফ্রিকোয়েন্সি
শুধু একটি ফ্রিকোয়েন্সিতে কাজ করে যা ৭০ মিটার বা ২৩০ ফুটের মধ্যে ট্রান্সমিশন উপযোগী। ট্রান্সমিশন গতি ১ থেকে ১০ এমবিপিএস।
হাই-পাওয়ার সিঙ্গেল ফ্রিকোয়েন্সি
অনেক বেশী জায়গা পর্যন্ত সিগনাল পাঠানো যায়। চলার পথে কোনো বাধা থাকলে তা ভেদ করতে সক্ষম। ট্রান্সমিশন গতি ১ থেকে ১০ এমবিপিএস।
স্প্রেড স্পেকট্রাম
সিঙ্গেল ফ্রিকুয়েন্সি ট্রান্সমিশনে কেবল একটি ফ্রিকুয়েন্সি ব্যবহার করা হয়, আর স্প্রেড স্পেকট্রাম রেডিও ট্রান্সমিশনে একাধিক ফিকুয়েন্সি ব্যবহার করা হয়।
রেডিও ওয়েভ এর ব্যবহার
১। রেডিও বা বেতার যন্ত্রে ব্যবহার করা হয়।
২। মোবাইল যোগাযোগের লিংক স্থাপনে।
৩। টেলিভিশন ব্রডকাস্টিং।
৪। ইন্টারনেট সংযোগের জন্য টাওয়ার টু টাওয়ার রেডিও লিংক ব্যবহার করা হয়।
রেডিও ওয়েভ এর সুবিধা
১। রেডিও ওয়েব বিল্ডিং বা দেয়াল ভেদ করতে পারে।
২। কোন প্রকার ক্যাবল দরকার হয় না।
৩। ট্রান্সমিটার এবং রিসিভার একই সরল রেখায় থাকার প্রয়োজন নেই।
৪। রেডিও ওয়েব বায়ুমণ্ডল দ্বারা শোষিত হয় না, ফলে বায়ুমণ্ডল দ্বারা সামান্যই প্রভাবিত হয়।
রেডিও ওয়েভ এর অসুবিধা
১। রেডিও ওয়েব ট্রান্সমিশনে নিম্নসীমার ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহৃত হয়, বিপুল পরিমাণ তথ্য একসাথে প্রেরণ করা সম্ভব হয় না।
২। রেডিও ওয়েব সাস্থের জন্য ক্ষতিকর।
মাইক্রোওয়েভ
300MHz হতে 300GHz ফ্রিকোয়েন্সির ইলেকট্রোম্যাগনেটিক স্পেকট্রামকে বলা হয় মাইক্রোওয়েভ। এই তরঙ্গের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য 1mm থেকে 1m পর্যন্ত হয়ে থাকে। মাইক্রোওয়েভ বাঁকা পথে চলতে পারে না। মাইক্রোওয়েভ সিস্টেম মূলত দুটো ট্রান্সসিভার নিয়ে গঠিত। এর একটি সিগন্যাল ট্রান্সমিট এবং অন্যটি রিসিভ করার কাজে ব্যবহৃত হয়। যেহেতু মাইক্রোওয়েভ বাঁকা পথে চলতে পারে না তাই ট্রান্সমিটার এবং রিসিভার মুখোমুখি থাকতে হয়। মাইক্রোওয়েভের অ্যান্টেনা কোনো ভবন বা টাওয়ারের উপর বসানো হয় যাতে সিগন্যাল বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে এবং পথে কোনো বস্তু প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে। অধিক দূরত্বের যোগাযোগে মাইক্রোওয়েভ অত্যন্ত জনপ্রিয়। মাইক্রোওয়েভ মাধ্যম ব্যবহার করে ডেটা, ছবি, শব্দ স্থানান্তর করা সম্ভব।
মাইক্রোওয়েভের বৈশিষ্ট্য
১। মাইক্রোওয়েভ বাঁকা পথে চলতে পারে না।
২। মাইক্রোওয়েভ সিস্টেম মূলত দুটো ট্রান্সসিভার নিয়ে গঠিত। এর একটি সিগন্যাল ট্রান্সমিট এবং অন্যটি রিসিভ করার কাজে ব্যবহৃত হয়।
৩। মাইক্রোওয়েভ মাধ্যমে প্রেরক ও প্রাপকের মধ্যে কোনো বাধা থাকলে ডেটা ট্রান্সমিট করতে পারে না।
৪। মাইক্রোওয়েভের এন্টিনা বড় কোনো ভবন বা টাওয়ারের উপর বসানো হয় যাতে সিগন্যাল বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে।
মাইক্রোওয়েভ দুই প্রকার।
১। টেরেস্ট্রিয়াল মাইক্রোওয়েভ
২। স্যাটেলাইট মাইক্রোওয়েভ
টেরেস্ট্রিয়াল মাইক্রোওয়েভ
এই ধরণের প্রযুক্তিতে ভূপৃষ্টেই ট্রান্সমিটার ও রিসিভার বসানো হয়। ট্রান্সমিটার ও রিসিভার দৃষ্টি রেখায় যোগাযোগ করে। কোনো বাধা না থাকলে ১ থেকে ৫০ মাইল পযর্ন্ত ডেটা চলাচল করতে পারে।
স্যাটেলাইট মাইক্রোওয়েভ
এক্ষেত্রে সিগনাল পাঠানোর জন্য ভূ-পৃষ্ঠে থাকে স্যাটেলাইট এন্টেনা এবং মহাশুণ্যে তাকে স্যাটেলাইট। স্যাটেলাইট বা উপগ্রহ মহাকাশে থেকে পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ বলের কারণে পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরতে থাকে। সৌরশক্তি ব্যবহারের কারণে উপগ্রহ মহাকাশে রাখতে জ্বালানি বা শক্তি খরচ করতে হয় না। স্যাটেলাইটের মৌলিক উপাদানগুলো হল প্রাপক এন্টেনা, প্রেরক এন্টেনা ও ট্রান্সপন্ডার। পৃথিবীতে অবস্থিত স্টেশনগুলোতে শক্তিশালী এন্টেনা থাকে যার নাম VSAT(Very Small Aperture Terminal)। ট্রান্সমিটারগুলো স্যাটেলাইটকে মাইকোওয়েভ সিগন্যাল প্রেরণ করে। স্যাটেলাইটে পাঠানোর পর এই সংকেত অত্যন্ত ক্ষীণ হয়ে পড়ে। স্যাটেলাইটে অনেকগুলো ট্রান্সপন্ডার থাকে যা ক্ষীণ সংকেতকে অ্যামপ্লিফাই করে পৃথিবীর গ্রাহক যন্ত্রে পাঠায়।VSAT এন্টেনাগুলো সবসময় স্যাটেলাইটের দিকে রাখতে হয়। স্যাটেলাইটগুলো অনেক দূরে অবস্থিত থাকার কারণে অধিক শক্তিতে বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ বিকিরণ করতে হয়। মহাশুণ্যে অবস্থিত স্যাটেলাইট ও ভু-পৃষ্ঠের ডিশ এন্টনার মধ্যে দুরত্ব প্রায় ৫০, ০০০ কি.মি।
স্যাটেলাইটের ব্যবহার
১। টেলিভিশন সিগন্যাল পাঠানোর কাজে।
২। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের ক্ষেত্রে।
৩। ইন্টারনেট সংযোগের ক্ষেত্রে।
৪। আবহাওয়ার সর্বশেষ অবস্থা পর্যবেক্ষণে ।
মাইক্রোওয়েবের সুবিধা
১। ব্যান্ডউইথ অনেক বেশি তাই এটি ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ তথ্য একইসাথে ট্রান্সমিট করা যায়।
২। কোন প্রকার ক্যাবল ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না।
৩। পাহাড়ি ও দূরবর্তী অঞ্চলে যোগাযোগের জন্য এটি সুবিধাজনক।
মাইক্রোওয়েবের অসুবিধা
১। মাইক্রোওয়েভ বাঁকা পথে চলতে পারে না।
২। মাইক্রোওয়েভ মাধ্যমে প্রেরক ও প্রাপকের মধ্যে কোনো বাধা থাকলে ডেটা ট্রান্সমিট করতে পারে না।
ইনফ্রারেড
৩০০GHz হতে ৪০০THz ইলেকট্রোম্যাগনেটিক স্পেকট্রামকে বলা হয় ইনফ্রারেড। এই তরঙ্গের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ৭৫০nm থেকে ১mm পর্যন্ত হয়ে থাকে। খুবই নিকটবর্তী দুটি ডিভাইসের মধ্যে যোগাযোগে ব্যবহৃত হয়।
ইনফ্রারেডের সুবিধা
১। দামে সস্তা।
২। বিদ্যুৎ শক্তির প্রয়োজন কম।
৩। স্বল্প দুরুতে (প্রায় ১০ মিটার ) ভালো কাজ করে।
ইনফ্রারেডের অসুবিধা
১। অধিক দূরুতে ডেটা ট্রান্সমিট করতে পারে না।
২। ট্রান্সমিটার ও রিসিভারের মধ্যে কোন প্রতিবন্দক থাকলে কাজ করে না।
ইনফ্রারেডের ব্যবহার
১। রেডিও, টিভি, এসি ইত্যাদির রিমোট কন্ট্রোল সিস্টেমে।
২। কম্পিউটারের তারবিহীন কিবোর্ড, মাউস, প্রিন্টার ইত্যাদির সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার কাজে।
তারবিহীন মাধ্যমের গুরুত্ব
দূরবর্তী ও দূর্গম স্থানসমূহের মধ্যে ডেটা কমিউনিকেশনের ক্ষেত্রে তারবিহীন মাধ্যম উপযোগী। বহনযোগ্য ডিভাইসের (মোবাইল, ল্যাপটপ, ট্যাবলেট ইত্যাদি) মধ্যে ডেটা কমিউনিকেশনের ক্ষেত্রে তারবিহীন মাধ্যম ব্যবহার বেশি উপযোগী।
মোঃ আবু সাঈদ
প্রভাষক (আইসিটি)
একজন দক্ষ, উদ্ভাবনী এবং প্রযুক্তি-বান্ধব আইসিটি শিক্ষক, যিনি শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রযুক্তি জ্ঞানের বিকাশ এবং ব্যবহারিক দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নিবেদিত। কম্পিউটার বিজ্ঞান, প্রোগ্রামিং, ডিজিটাল লিটারেসি এবং আধুনিক সফটওয়্যার/হার্ডওয়্যার প্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদানে অভিজ্ঞ। শিক্ষার্থীদের বয়স ও শ্রেণি অনুযায়ী উপযোগী পাঠ পরিকল্পনা তৈরি এবং বাস্তবভিত্তিক কার্যক্রমের মাধ্যমে ক্লাস পরিচালনায় দক্ষ। কম্পিউটার নেটওয়ার্কিং, গুগল ও মাইক্রোসফট অ্যাপ্লিকেশন, PHP, C/C++, JavaScript, পাইথন, এইচটিএমএল/সিএসএস সহ বিভিন্ন ডিজিটাল টুল ও প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারে পারদর্শী।
সাজানো-গুছানো এবং কোয়ালিটিফুল ক্লাস কন্টেন্ট দ্বারা অফলাইন অথবা অনলাইনে এইচএসসি ও আলিম শিক্ষার্থীদের আইসিটি কোচিং করানো হয়।
Poralekha24.com: স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থীদের জন্য Lecture Sheet, MCQ/CQ, Presentation ও অনলাইন ও অফলাইন কোচিং সেবা।
কপিরাইট © ২০২৫ - ২০২৫ Poralekha24.com. সকল অধিকার সংরক্ষিত।